কদিন থেকে প্রচণ্ড জ্যামের কারণে অফিসের গাড়িতে বাসায় ফিরতে বাড়াবাড়ি রকম দেরি হচ্ছিল। মিরপুর পৌছতে কখনো আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যেত। খুব আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছিলাম কবে থেকে রাতে মেট্রোতে করে বাসায় ফিরতে পারব। কবে থেকে চালু হচ্ছে সে ব্যাপারে কোনো কিছুই জানা যাচ্ছিল না।
একদিন সহকর্মী ফাহিমা জানালেন জানুয়ারির ৪ তারিখ থেকে চালু হবে। ফাহিমা প্রায়ই মেট্রো ব্যবহার করে। ওর বাসা ১২ নম্বর স্টেশনের পাশেই। সহকর্মী মনির খান ওরা নাম দিয়েছে ‘মেট্রো গার্ল’। ঠিক কবে থেকে মেট্রো পুরোদমে চলাচল করবে গুগুল করেও কোনো মিডিয়ায় খবরের সত্যতা জানা যাচ্ছিল না। হঠাৎ করেই ঘোষণা হলো যে, ২০ শে জানুয়ারি শনিবার থেকে চালু হচ্ছে। সেদিন বিকেলে রওনা দিতে চাচ্ছিলাম। কী ভেবে সেদিন আর যাওয়া হয়নি।
মেট্রোরেলের পুরো সক্ষমতার দ্বিতীয় দিন ২১ জানুয়ারি রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় প্রেসক্লাব গিয়ে সচিবালয় স্টেশনে উঠে আমার চক্ষু চরকগাছ। লোকে গিজগিজ করছে দোতলার কনকোর্স। টিকেট সংগ্রহের বিরাট বিরাট লাইন। যেতেই হবে ভেবে সামনে পড়া লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়াই। অন্যদিকে খেয়াল করার তখন হুঁশ নেই। আমার সামনে তখনো প্রায় দুই শ জন। গোনার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। আহারে যদি এমআরটি পাসটা না হারাতাম তাহলে তো এ রকম লাইনে দাঁড়াতে হতো না। ৮/১০ মিনিটের মধ্যে আমার অবস্থান এমন জায়গায় যে, তখন সামনে মাত্র ১৫/২০ জন লোক। এমন সময় জানতে পারলাম যে, এ লাইনটি তাদের জন্য যারা মেশিনে টিকেট কাটতে পারে না। সম্পূর্ণ নন ডিজিটাল- আনস্মার্ট সিটিজেনদেন। আমি তো মেশিনে টিকেট কাটতে জানি! তখন আর মেশিনের লাইনে গিয়ে লাভ নেই। বরং উম্মিদের সাথে নগদ টাকায় টিকেট কাটার অভিজ্ঞতাটিই নিই না কেন।
টিকেট কেটে ৩য় তলায় সচিবালয় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উঠার পালা। এ সন্ধ্যায় রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কেতাদূরস্ত এক যাত্রীর পেছন পেছন লিফটে উঠে যাই। উপরে উঠে দেখি আমাদের অবস্থান মতিঝিলগামী প্লাটফর্মে। উল্টাপাশে উত্তরাগামী প্লাটফর্ম। অগত্যা আবার নিচে গিয়ে সঠিক সিঁড়িতে করে উত্তরাগামী প্লাটফর্মে পৌছি। বিপুল সংখ্যক যাত্রী অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্য।
ট্রেন এলো। আগের মতিঝিল স্টেশন থেকে ভরে এসেছে ট্রেন। বেপরোয়াদের সঙ্গে বেপরোয়া কায়দায় উঠে যাই। পেছনে অনেকেই উঠতে পারেননি। ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড়। দাঁড়িয়েছি দরজার নিকটেই। ২/৩ জন কম বয়সী নারী যাত্রীও উঠেছে। মতিঝিল-গুলশান-বনানী ৬ নম্বর কিংবা রামপুরা-মালিবাগ-সদরঘাট রুটের বাসে যাত্রীদের ভিড়ের কথা মনে পড়ল। চিরে চেপ্টা হওয়ার মতো এ রকম জায়গায় নারীদের ওঠা বিব্রতকর। যদিও তাদের জন্য ট্রেনের সবচেয়ে সামনের কোচটি সংরক্ষিত। মেয়েদের সামনে পেছনে সাইডে গাদা গাদা করে দাঁড়ানো ছিল ছেলেরা।
আমার ডানহাতে ছিল হাতব্যাগ। বামহাতে মোবাইল ও মেট্রোর টিকেট, পেছনের পকেটে মানিব্যাগ। পকেটমার থাকা অবাস্তব নয়। গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু হাতে নিয়ে নিই। ফলে ধরতে পারছিলাম না কোথাও। ব্যথায় হাত টনটন করতে থাকে।
অতি ভাগ্যবানেরা মতিঝিল থেকে সিট পেয়ে আরামে বসে যাচ্ছেন। সচিবালয় থেকে যারা উঠতে পেরেছেন তারাও কম ভাগ্যবান নন। ঘোষণা দেওয়া হলো: যারা উঠতে পারেননি তারা পরের ট্রেনে যেতে পারবেন। উল্লেখ্য, কদিন আগে আমিও মিরপুর থেকে ট্রেন মিস করেছিলাম ভুল জায়গায় দাঁড়ানোর কারণে। আমি দাঁড়িয়েছিলাম একেবারে পেছনের কোচের সামনে।
বসে থাকা যে ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়ালাম তিনি লেদার জ্যাকেট পরেছেন। কোলেও একটি লেদারের ব্যাগ। মাথার সামনের অর্ধেকটা পরিষ্কার টাক। বয়স ৫৫-৫৭ হবে। পকেট থেকে স্যামসাং মোবাইলটা বের করে ফেসবুকে স্ক্রল করছেন। লোকটার প্রতি আমার হিংসে হলো। এই লোকটাই সেই ৩/৪কোটি মানুষের একজন যারা বাংলাদেশে বসে ইউরোপ-আমেরিকার লাইফস্টাইল চালাচ্ছে। সন্ধ্যার মেট্রোযাত্রীরা সব ঘরমুখো মানুষ। এদের বয়স ৩০ থেকে ৫৫ এর ভেতরে। সবাই সক্ষম ও উপার্জনক্ষম কিংবা উপার্জনের আশায় ছুটন্ত। নিম্ন আয়ের মানুষ মেট্রোতে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করতে পারবে বলে মনে হয় না। তাদের জন্য ডিসকাউন্ট টিকেটের বিশেষ ব্যবস্থা থাকা দরকার। উন্নয়নের সুবিধা তাদেরও পাওয়া সঙ্গত।
অন্য যাত্রীরা কে কি করছে দেখার জন্য এদিক ওদিক তাকাই। লোকেরা বেকারই বসে আছে। কেউ ঝিমুচ্ছে। আসলে এখনো উন্নত বিশ্বের মতো দৃষ্টিনন্দন মেট্রো সংস্কৃতি চোখে পড়ছে না। কেউ পড়ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন থেকে ৪/৫ জন উঠলেন। উঠলেন শাহবাগ থেকেও। মনুষ্যগোষ্ঠীর গুনগুনানি শোনা যাচ্ছে বেশ। রাতের মেট্রোরেলের কাচের ভেতর দিয়ে বাইরের ভবনের আলো অনেকটাই ম্লান মনে হলো। চোখে পড়লো বাংলামোটর মোড়ের রূপায়ন টাওয়ার, সোনারগাও হোটেল, এটিএন বাংলা। কারওয়ান বাজারে আসার পর মনে হলো ট্রেনটি যেন একটি মাছের বাজার। মনুষ্যগোষ্ঠীর বাজিং সত্যিই শ্রবণকটূ। এ স্টেশন থেকে বহু যাত্রী ট্রেনে উঠতেই পারেননি। তাদের হইচই শোনা যাচ্ছিল ভেতর থেকে।
বিজয় সরণির পরের অংশটা বিশেষত জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড তথা পুরাতন বিমানবন্দরের ফাঁকা এলাকা এবং ঝিলগুলো রাতে ট্রেন থেকে বেশ লাগে। আগারগাও, শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়ায় কিছু যাত্রী নেমে গেলেন। আবার উঠলেনও সমপরিমাণ। তাতে ভিড় একটুও কমল বলে মনে হয়নি।
১০ নম্বর স্টেশনে নেমে গেলো বিপুল সংখ্যক যাত্রী। তার মানে ট্রেন কিন্তু খালি হয়ে যায়নি। কনকোর্স থেকে বের হতে গিয়ে রীতিমতো মানবজটের অবস্থা। জরুরি মুহূর্তে এ রকম জায়গা সত্যিই কঠিন। এক্সিট ব্যবস্থাপনায় আরো উন্নতি ঘটাতে হবে। আর যা সবচেয়ে বেশি দরকার তা হলো ট্রেনের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়াতে হবে। ২/৩ মিনিট পর পর ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে মনে হয় যাত্রীদের জন্য আরো স্বাচ্ছন্দ্য আনা সম্ভব হবে। এখানে বলে রাখি, ৩ তলায় প্লাটফর্মে পাবলিক টয়লেট আছে। মিরপুর ১০ স্টেশনে গতকাল ব্যবহার করে দেখেছি টয়লেট এখনো ঠিকঠাকই আছে। টিকেটের দাম ১০ টাকা। পরিষ্কার করার ফ্রিকোয়েন্সি আরো বাড়াতে হবে।
আমাদের মেট্রো বিশ্বমানের। তবে নিট এন্ড ক্লিন কতটা থাকবে সময়ই সেটি বলে দেবে। আমাদের আবহাওয়া খারাপ। শীতকালে ধুলা আর বর্ষা
লেখক: মো: ইয়াকুব আলী, পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ), গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, ঢাকা।