মাশরিক_থেকে_মাগরিব : দর্শনা টু মেহেরপুর দর্শনা-মুজিবনগর সড়ক ধরে এগিয়ে চলে গাড়ি। পেছন দর্শনা। দর্শনা একটি পৌরসভা। দামুড়হুদা উপজেলার মধ্যে একমাত্র পৌরসভা । শুরুতে দামুড়হুদায়ই নাকি মহকুমা সদর হয়েছিল। পরে তা চুয়াডাঙ্গায় স্থানান্তরিত হয়। মুজিবনগরগামী সড়কে মাথাভাঙ্গা নদীর ওপর বেইলি ব্রিজের স্থলে নির্মিত হয়েছে ‘গলাই দড়ি সেতু’। আরো সামনে গিয়ে রাস্তার ডানপাশে পড়ল বিশাল জলরাশি। এত বড় জলাশয় এ অঞ্চলে খুব একটা চোখে পড়েনি। এটি রাইসা বিল। বর্ষাকালে নাকি এ বিলে কচুরিপানা ফুলের অপূর্ব সৌন্দর্য দর্শকদের মন মাতায়। আরো সামনে রাস্তার ডানে কাজী নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত মাটির দেয়াল ও ছনের ছাউনির ’আটচালা ঘর’। এলাকাটি দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গায়। ১৯২৬ সালে কবি এখানে সপরিবারে দুই মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত করেন বলে তথ্যবোর্ড থেকে জানা যায়। ভিটার মালিক হর্ষপ্রিয় বিশ্বাস। তিনি খ্রিস্টসম্প্রদায়ের একজন শিক্ষক,স্বদেশী ও কংগ্রেস নেতা ছিলেন। তার উত্তরসূরির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। ২০২১ সালে সরকারি উদ্যোগে ঘরটির সংস্কার করা হয়েছে। ‘তাল সারি’ চুয়াডাঙ্গার একটি দর্শনীয় স্থান। মুজিবনগরগামী সড়কের বামপাশে ভেতরের দিকে চলে গেছে একটি রাস্তা। রাস্তার দুপাশে তালগাছের সারি। কোনো কোনো গাছ ১০০ মিটারের চেয়ে উঁচুই হবে। ফাঁকে ফাঁকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে তালের নতুন চারা। তাল সারির ডিসি পার্কের রেস্টহাউসে চায়ের আয়োজন করেছিল মামুন। পিঁয়াজুর অর্ডার দেওয়া ছিল আগে থেকেই। একেকটি পিঁয়াজুর ওজন নাকি ৫ কেজি। কেটে বা ভেঙে বিক্রি করা হয়।” পিঁয়াজু খেতে খেতে রেস্টহাউসের তত্ত্বাবধায়কের মুখ থেকে তালসারি ও পার্কের গল্প শোনা হলো: গ্রামের নাম নাটুদাহ। জমিদারের নাম শ্রী নফর পাল চৌধুরী। রাধারানী তাঁর স্ত্রী। দেশ বিভাগের পর সাড়ে নয় হাজার বিঘা জমি ফেলে ভারতে চলে যান। কিছু জমি স্থানীয়দের দান করেছেন বাকিটুকু দাঙ্গাবাজ পাবলিক নিজেদের নামেই রেকর্ড করেছে। ৪০০ বিঘা জমি পাকিস্তান সরকার হয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে আছে। সেখানেই তৈরি করা হয়েছে ডিসি ইকো পার্ক। জমিদারের স্ত্রীর অভিপ্রায়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৯০৯ সালে। কথা ছিল স্কুল ঘর হবে হাজার দূয়ারের। যদিও হাজার দরজার ভবন নির্মাণ শেষ হয়নি তারপরও স্কুলটি পরিচিত পেয়েছে হাজার দূয়ারী স্কুল নামে। আমবাগান, পুকুর ও সুবিশাল মাঠসহ স্কুলের চৌহদ্দির জমির পরিমাণ ৯ একর ১২ শতক। সেটিই নাটুদাহ হাই স্কুল। জমিদার বাড়িতে নাকি পুকুর ছিল দুটো: একটি পাবলিকের জন্য, অন্যটি জমিদারের প্রাইভেট পুকুর। জমিদার বলে কথা। রেস্ট হাউস থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি উঁচু তালগাছের মাথায় প্রায় পূর্ণবৃত্ত চাঁদ উঠেছে। পৌষের মরা চাঁদ। কুড়ুলগাছি নামক স্থানে আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধিক্ষেত্রটি ‘আটকবর’ নামে পরিচিত। স্মৃতিস্তম্ভ করে জায়গাটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে যথাযথ মর্যাদায়। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় বন্ধ। আটকবরের পাশেই একটি খ্রিস্টান গির্জা। সেদিন ছিল বড়দিন। আলোকসজ্জা করা হয়েছে। কিছুদূর গিয়ে আরো একটি গির্জা। মেহেরপুরের অফিসার মামুন বললেন, মেহেরপুরে নন-মুসলিমদের মধ্যে খ্রিষ্টানরাই সংখ্যায় বেশি। আরো কতদূর গিয়ে দেখা মিলল একটি খ্রিস্টান পল্লীর। লোকজন জড়ো হয়েছে রাস্তার ডানপাশে একটি চার্চে। বড়দিন উপলক্ষে একটা উতসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছিল এলাকায়। মামুন আগেই বলে রেখেছিল নিপা ভাইরাস প্রুফ খেজুর রসের ব্যবস্থা করা হবে। সার্কিট হাউসে পৌছার পর পরিবেশিত হলো দুস্প্রাপ্য এই বস্তু। আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন আগে থেকেই সার্কিট হাউসে অবস্থানরত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পিআরও শিবলি। গাছিকে আগেই অর্ডার করা ছিল নেট দিয়ে বেড় দিয়ে রস সংগ্রহ করতে। সন্ধ্যার রস সংগ্রহ করার জন্য লোক পাঠানো হয়েছিল গাছির কাছে। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে প্রচুর খেজুর গাছ রয়েছে। রাতের খাবার খেয়ে মামুনের সাথে বের হই সীমান্ত এলাকায় ঘোরাঘুরি করার জন্য। সবার জানা, মেহেরপুর সদর উপজেলার বৈদ্যনাথতলায় ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেছিল অস্থায়ী সরকার। আগে মেহেরপুর ছিল দুই উপজেলার জেলা: সদর ও গাঙনী।
২০০০ সালে মুজিবনগর নামে জেলার তৃতীয় উপজেলা গঠন করা হয়। এখানে বলে রাখা ভালো আগে জানতাম মেহেরপুর দেশের সবচেয়ে ছোট জেলা। এখন জানা যাচ্ছে আয়তনের দিক দিয়ে ছোট জেলা নারায়ণগঞ্জ। দেশবিভাগের আগে কুষ্টিয়া (কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর) ছিল নদীয়া জেলার একটি মহকুমা মাত্র। নদীয়া জেলার বৃহত্তম শহর ‘কৃষ্ণনগর’ মেহেরপুরের কাছেই। রাত তখন ১০ টা। বাজিতপুর সীমান্তের পথে চলছি আমরা। রাস্তাটি খানাখন্দে ভরা। সারাদিনের প্রচুর খাওয়া দাওয়ায় এমনিতেই হাঁসফাস করছিলাম। তার ওপর অমসৃণ রাস্তা। এ রাস্তায় বাড়িঘর কম। মাঝে মাঝে চায়ের দোকানগুলোতে নির্বাচনী আড্ডা চলছিল। কোথাও কোথাও লক্ষ্য করি গেদারিং। একজন প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের গাড়িও দেখলাম পার্ক করা আছে। মেহেরপুরে নির্বাচনী উত্তাপও পাওয়া গেল বেশ। মামুনের আগ্রহে একাধিক পয়েন্টে অন্ধকারের সীমান্ত এলাকা দেখা হলো। কাঁটাতারের বেড়া আর বিএসএফের সার্চলাইটই চোখে পড়ল। সুনশান পরিবেশ। গরুচোর ভেবে বিএসএফ আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে বসে কিনা সে আশঙ্কাও ছিল।
সীমান্ত এলাকা থেকে ফিরি ভিন্ন রাস্তায়। এ রাস্তাটি অবশ্য মসৃণ। রাতের শেষ চা খাওয়া হয় সরকারি কলেজ মোড়ে। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গায় অনেকগুলো নীলকুঠি আছে। একটি হলো ‘আমঝুপি নীলকুঠি’। সকালে শহর থেকে ১৫/২০ মিনিটের মধ্যেই পৌছে যাই আম ঝুপিতে। ২৬ মার্চ, ১৯৭৯ সালে জেলা প্রশাসক স্থাপিত তথ্যবোর্ডের তথ্য মতে ইংরেজ আমলের সূচনাপর্বে বাংলার নিযাতিত মানুষের নীল রং রক্তে গড়ে উঠে আমঝুপি নীলকুঠি। কাজলা নদীর তীরে আমঝুপি নীলকুঠির অবস্থান। ১৩ কক্ষের আয়তাকার একতলা ভবনে আছে শয়ন কক্ষ, জলসাঘর, রেকর্ড রুম। ছিল মৃত্যুকূপ। শয়নকক্ষটি স্নেইক প্রুফ। মেঝে এত পিচ্ছিল করে বানানো হয়েছে যে এখানে পিপড়া বা সাপ চলাচল করতে পারে না। শীতপ্রধান ইংল্যান্ডের সাহেবদের বুদ্ধি ছিল বটে। ঝোপ-জঙ্গলে পরিপূর্ণ বাংলায় সাপখোপের হানা থেকে বাঁচতে কি ইনোভেটিভ আইডিয়া! ফায়ারপ্লেসও রয়েছে ভবনে। জলসাঘরের মেঝে পুরোটাই কাঠের। কুঠির শয়নকক্ষের নিচ দিয়ে নদী।# লেখক: মো: ইয়াকুব আলী, পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ), গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, ঢাকা।
লেখক: মো: ইয়াকুব আলী, পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ), গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, ঢাকা ।