বাগেরহাট থেকে এবার পরিবেশবান্ধব কাঠের তৈরি ঘর যাচ্ছে ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামে। খুব শিগগির কাঠের তৈরি ঘরের প্রথম চালানটি যাবে বলে আশা ন্যাচারাল ফাইবার্স নামের প্রতিষ্ঠানটির। প্রথমবারের মতো তাদের তৈরি করা পরিবেশবান্ধব ঘর বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় খুশি প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা। আগামীতে ইউরোপের বড় বাজার ধরতে সরকার তাদের সহযোগিতা করবে সেই আশা প্রতিষ্ঠানটির। একের পর এক পরিবেশবান্ধব পন্য তৈরি করে সবার নজর কেড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের পন্য বিদেশে রপ্তানিতে দেশে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।
নতুন সব উদ্ভাবনী পণ্য নিয়ে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশকে চেনানো মোস্তাফিজ আহমেদের (৫৭) সঙ্গে তার ব্যবসার হাল ধরে আছেন ছোট ভাই মোজাহিদ আহমেদও (৫৪)।
বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়ক থেকে নেমেই বাগেরহাট সদর উপজেলার রাখালগাছি ইউনিয়নের কররী গ্রাম। ২০১৭ সালে এই গ্রামে একর জমির উপর গড়ে উঠেছে ন্যাচারাল ফাইবার্স নামের এই প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠান দুই দশকের বেশি সময় ধরে পরিবেশবান্ধব সরঞ্জাম তৈরি করে সাড়া ফেলেছে। প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি হওয়া পরিবেশবান্ধব নানা সরঞ্জাম দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশে। একদিকে বাড়ছে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি আয় অন্যদিকে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি সামনে এগিয়ে যাবে সেই প্রত্যাশা এখানকার কর্মরতদের।
প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় যেয়ে দেখা গেল একদল দক্ষ কারিগররা তাদের নিপুন হাতে কাজ করছেন। কেউ কাঠের উপর নকশা করছেন, কেউ নকশার উপর সিরিস কাগজ দিয়ে ঘষছেন। কেউ কাঠে আঠা দিয়ে ফিটিং করছেন। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। এই শ্রমিকদের তৈরি কাঠের নানা সরঞ্জাম দিয়ে একটি কাঠের ঘর তৈরি করেছেন। বাইরে থেকে ঘরটি দেখলে বিষ্মিত হতে হবে। অসাধারণ তাদের নিপুনশৈলী। কাঠের তৈরি ঘরটি কয়েকটি লোহার খাম্বার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে পাঁয়ে হেঁটে প্রথমেই ঘরে ঢোকার প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বার থেকে ভেতরে ঢুকলে মনে হবে আপনি একটি রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়েছেন। ভেতরে দুটি শোবার ঘর, একটি অতিথিশালা, সামনের অংশে বাইরের প্রাকৃতিকদৃশ্য দেখার বসার স্থান। সব মিলিয়ে ভেতরটি দৃষ্টিনন্দন।
ন্যাচারাল ফাইবার্সের উৎপাদন ব্যবস্থাপক শংকর বিশ^াস বলেন, আমরা মূলত ইউরোপের বাজারটি ধরার চেষ্টা করেছি ইতিমধ্যে আমরা সফলও হয়েছি। কাঠের তৈরি ঘরের বড় একটি অর্ডার আমরা পেয়েছি। এটা দেশের জন্য গর্বের। যে কাঠের ঘর আমরা তৈরি করেছি তা শতভাগ পরিবেশবান্ধব। প্রত্যন্ত গ্রামে এই কারখানাটি গড়ে উঠেছে। এখানে দেড়শ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখানকার শ্রমিকরা সবাই দক্ষ কারিগর। সামনে আরও শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। এই শ্রমিকরা বর্তমানে তিনদিনের মধ্যে একটি কাঠের ঘর তৈরি করতে পারে। বেলজিয়ামে যে অর্ডারটি আমরা পেয়েছি সেই ঘর ফিটিং করতে এই শ্রমিকরাই ওই দেশে যাবে। ইউরোপের ভিসা পাওয়া অনেক কঠিন। এখানকার শ্রমিকরা সেই ভিসা পাচ্ছে এটা অকল্পনীয়। আমরা ইতিমধ্যে ১২০টি ঘরের অর্ডার পেয়েছি। ভবিষ্যতে আরও পাব। আমরা যে কাঠের ঘর তৈরি করেছি তা থ্রিস্টার মানের। এই ঘরের মধ্যে কিচেন, বেড়রুম, বাথরুম ও গেস্টরুম রয়েছে। বাগেরহাটের অজপাড়াগাঁয় গড়ে ওঠা ন্যাচারাল ফাইবার্স নামের এই প্রতিষ্ঠানটির খ্যাতি বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটি শুধু দেশে না সারাবিশে^র মানুষের কাছে পরিচিতি পাবে বলে আশা এই কর্মকর্তার।
ন্যাচারাল ফাইবার্সের প্রতিষ্ঠাতা সত্ত¡াধিকারী ও সফল উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, কাঠের তৈরি ঘর যাবে ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের একটি ইকোপার্কে। পার্কের নাম পাইরিডাইজার। এই পাইরিডাইজার পার্কের কাছ থেকে ক্রয় আদেশ নিয়েছে গ্রীসের একটি প্রতিষ্ঠান কোকোম্যাট। এই কোকো ম্যাটের সাথে ন্যাচারাল ফাইবার্সের ব্যবসা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। কোকো ম্যাট নামের ওই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের কাজটি দিয়েছে। কাঠের তৈরি ঘরের নকশা দিয়েছে। ঘরে কি ধরনের কাঠসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে তার তালিকা দিয়েছে। ইতিমধ্যে তাদের দেয়া নকশা অনুযায়ি ঘর তৈরি করেছি। পাইরিডাইজার ইকোপার্ক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে এসে কাঠের তৈরি ঘর পরিদর্শন করে তা নিতে অনুমোদন দিয়েছে। তাদের আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে মোট ১২০টি ঘর তৈরি করে তা সেট করে দিয়ে আসার চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশের কারখানায় ঘরগুলো তৈরি করে কার্টুনে প্যাকেট করে বেলজিয়ামে নিয়ে আমাদের দেশের মিস্ত্রিরা তা সেট দিয়ে আসবে। এই ঘরে ব্যবহ্নত কাঠ আমাদের দেশে পাওয়া যায়না। এজন্য আফ্রিকার দেশ ঘানার একটি কোম্পানির মাধ্যমে কাঠ আমদানি করতে চুক্তি হয়েছে। এছাড়াও অনেক সরঞ্জাম আছে যা আমাদেশে নেই। সেইসব সরঞ্জাম লোহা, তামা, সিরামিক) ইউরোপ থেকে নিতে হবে। এই ঘরে ব্যবহ্নত সরঞ্জাম ইউরোপের স্ট্যান্ডার্ড হতে হবে। ওই দেশ এই ঘর দেখে সনদ দিবে। বাংলাদেশ থেকে এমন একটা কঠিন কাজ তাও আবার এমন একটি অজপাড়াগাঁয় বসে করতে হচ্ছে। তবে আশার কথা এই যে আমরা সফল হয়েছি। এই ঘরের দাম কেমন পড়বে জানতে চাইলে বলেন ব্যবহ্নত সরঞ্জামের দামের উপর নির্ভর করবে। তবে দাম আনুমানিক ৩০ হাজার ইউরোর মতন আসতে পারে।
এই ঘরে কাঠ ব্যবহার হয়েছে আফ্রিকার লোহা কাঠ (ইপে উড), দেশীয় মেহগনি, আম, জাম। এই ঘরে কোন ধরনের রং এর ব্যবহার করা যাবে না। হতে হবে ন্যাচারাল। জাহাজে করে এসব ঘর বেলজিয়ামে রপ্তানি করা হবে। বাংলাদেশের মোংলা সমুদ্র বন্দরে বেলজিয়ামের জাহাজ ভেড়ে না। যার কারনে চট্টগাম বন্দর ব্যবহার করতে হবে। কাঠের ফার্নিচার বিদেশে রপ্তানি করলে সরকার সাত শতাংশ ইনসেনটিভ দেয়। এটা আমরা পাব। পন্য রপ্তানিতে বন্দরে ব্যবসায়ীদের কিছু ঝামেলা ফেইস করতে হয় সেই ঝামেলা যাতে না হয় সেজন্য সরকারের সহযোগিতা চাইছি। এসব সমস্যা না থাকলে ভবিষ্যতে আরও বেশি করে ক্রয় আদেশ (ওয়ার্ডার) আনতে পারব। ইউরোপে আগে আশেপাশের ক্রোয়েশিয়া, বুলগেরিয়াসহ বেশকিছু দেশ কাঠের ঘর তৈরি করে বিক্রি করত। তারা এখন ধনী হয়ে গেছে। তারা এখন আর তৈরি করে না। বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমিকরা এখন এই কাঠের কাজ করে থাকে। পরিবেশ বান্ধব এই শিল্পটি সম্ভবনাময় শিল্প। ইউরোপে কাঠের তৈরি সরঞ্জামের একটি বড় বাজার ফাঁকা রয়েছে। এই বাজারটা ধরতে পারলে আমার মত অন্য উদ্যোক্তারাও সুযোগ পাবে বলে মনে করে মোস্তাফিজ আহমেদ।
গ্রীসের প্রতিষ্ঠান কোকো-ম্যাটের প্রতিষ্ঠাতা পল এমোফেডিস বলেন, বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ন্যাচারাল ফাইবার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব পন্য তৈরি করছে জানতে পেরে আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করি। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা পরিদর্শন করি। আমরা আমাদের চাহিদার পন্য তৈরির জন্য তাদের স্যাম্পল তৈরি করে দেখাতে বলি। তারা আমাদের চাহিদা অনুযায়ি পন্য তৈরি করে দিতে সক্ষম হয়েছে। আমরা তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। এই পন্য ইউরোপের দেশে খুব শিগগির নিতে পারব বলে আশা করছি।
২০০২ সালে বাগেরহাটের বিসিক শিল্প নগরীতে ফেলনা ছোবড়া দিয়ে তোশকের (ম্যাট্রেস) ভেতরের অংশ বা ‘কয়ার ফেল্ট’ উৎপাদনের উদ্যোগ নেন তিনি। ২০০৫ সালে প্রথম উৎপাদনে যায় তার কয়ার ফেল্ট কারখানা।
ছোবড়া থেকে কয়ার ফেল্ট তৈরির জন্য আঁশ আলাদা করতে গিয়ে টনকে টন গুঁড়ো বের হচ্ছে। যা কোনো কাজেই আসছিল না। সেই সমস্যার সমাধানও আসে নতুন পণ্য কোকো-পিট তৈরির মধ্য দিয়ে।
এরপর ২০১৭ সালে বাগেরহাট সদর উপজেলার রাখালগাছি ইউনিয়নের কররী গ্রামে ছয় একর জমির উপর ছোবড়া থেকে আঁশ তৈরির কারখানা স্থাপনের পর সেখানে তিনি নেন নতুন উদ্যোগ। শুরু হয় ফেলে দেওয়া ছোবড়ার গুঁড়ো দিয়ে কোকো-পিট বøক (মাটির বিকল্প হিসেবে টব)। ২০১৮ সালে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানির পর শুরু হয় কয়ার ফেল্ট উৎপাদন। দেশ থেকে আরেক নতুন রপ্তানি পণ্য হিসেবে যা গন্তব্য পায় দক্ষিণ কোরিয়ায়।
নারকেলের ছোবড়ার তৈরি আরেক নতুন পণ্য, একবার ব্যবহার উপযোগী ডিসপোজেবল হোটেল ¯িøপার দিয়ে আবারও ইউরোপের বাজারে পাড়ি জমায় প্রতিষ্ঠানটি।
সেই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটি এবার উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু করে শিশুদের জন্য কাঠের তৈরি বেবি ব্যালেন্স সাইকেল, খেলনাসহ নারকেলের ছোবড়ার তৈরি আরও কিছু নতুন ধরনের পণ্য। চলতি বছরে প্রতিষ্ঠানটি অন্তত ২০ হাজার বেবি ব্যালেন্স বাইসাইকেল রপ্তানি করবে। ap