বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে নানা ইস্যুতে টানাপোড়েনের কারণে ভিসা জটিলতায় ভুগছেন বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা। ভারত সরকার বাংলাদেশিদের সব ধরনের ভিসা দেওয়া সীমিত করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতে চিকিৎসক দেখানোর জন্য আগাম অ্যাপয়েন্টমেন্ট এবং ফলোআপ চিকিৎসার রোগীরা বেশি সমস্যায় পড়েছেন। এতে সম্প্রতি এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে রোগীরা চিকিৎসার জন্য ভারতের বিকল্প খুঁজছেন। তারা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে যাওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বর্তমান পরিস্থিতি দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য একটি বড় সুযোগ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের দাবি যারা চিকিৎসা জন্য বাইরে যাচ্ছেন তাদের দেশেই সেবা দেওয়া সম্ভব। কারণ কোভিডের সময় রোগীরা বাইরে যেতে পারেননি। দেশে চিকিৎসা নিয়েই সুস্থ হয়েছেন। অন্যদিকে কলকাতার কয়েকটি হাসপাতাল সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশি রোগীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা দিয়েছে। আইন মেনে চিকিৎসা পরিষেবা নিতে যাওয়া বাংলাদেশিদের চিকিৎসা পরিষেবায় ১০ শতাংশ ছাড়েরও ঘোষণা দিয়েছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আজ সোমবার ঢাকায় আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। দু’দেশের মধ্যে বৈঠক হবে। এতে উভয় দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি ভারত গমনে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা প্রদান সহজকরণের বিষয়টা আলোচনায় আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ থেকে ভারত প্রবেশের অনুমতিপত্র (ভিসা ইস্যু) দিতে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কসহ দেশে ১৫টি ভিসা সেন্টার রয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে সেন্টারগুলো দৈনিক গড়ে ২৭ থেকে ৩০ হাজার পাসপোর্ট গ্রহণ এবং ১৯ থেকে ২৫ হাজার ভিসা প্রদান করত। এর মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি ছিল সরাসরি মেডিকেল ভিসা। সম্প্রতি নানা ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করায় বাংলাদেশের নাগরিকদের ধীরে ধীরে সব ধরনের ভিসা দেওয়া সীমিত করেছে ভারত সরকার।
জানা গেছে বন্ধ্যত্ব, ক্যানসার, হৃদরোগ, লিভার ট্রান্সপ্লান্ট, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট, অর্থোপেডিকস্, নিউরোলজি ও চোখের চিকিৎসায় রোগীরা বেশি বিদেশে যান। এক্ষেত্রে কলকাতা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের একাধিক শহর, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালুরু, হায়দারাবাদ, মুম্বাই ও দিল্লিতে অবস্থিত হাসপাতালগুলো বেছে নেন। সেখানে উচ্চমূল্যে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতি বছর দেশের অর্থ বাইরে চলে যায়। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে এর ব্যত্যয় ঘটছে। মানুষ চিকিৎসার জন্য দেশটিতে যেতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা শাফায়েত হোসেন (৫৫) জানান, তিনিসহ পরিবারের ৩ সদস্য নিয়মিত ভারতে চিকিৎসা নিতেন। পাঁচ আগস্টের পর ফলোআপের জন্য তিনবার চিকিৎসকের মেইল পেয়েছেন। কিন্তু ঢাকার ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টার ভিসা দেয়নি। যথাসময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে গত মাসে তার ক্যানসার আক্রান্ত বোন মারা গেছেন। ভারতীয় ভিসা জটিলতায় পরিবারের অন্য সদস্যদের চিকিৎসায় এখন থাইল্যান্ডের যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে ভারতের যত ভিসা সেন্টার রয়েছে অন্য কোনো রাষ্ট্রেরই তা নেই। ভারতীয় মেডিকেল ট্যুরিজম শক্তিশালী ভূমিকা রাখায় ২০২২ ও ২০২৩ সালের তুলনায় চলতি বছরে (২০২৪) বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৪৭ গুণ। ই-ভিসার চালুর পর বছর শেষে এই হিসাব আরও বড় হতো।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত বছর (২০২৩) চিকিৎসা খাতে বৈধভাবে ১,৫৬ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বিদেশে নেওয়া হয়েছে। এগুলো গেছে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে। তবে বেশিরভাগ গেছে ভারতে। এ ছাড়া ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৫ লাখের মতো রোগী তাদের দেশে আসেন। স্বাস্থ্যসেবা নিতে রোগীরা প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ওই দেশে ব্যয় করেন। দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েনের কারণে গত জুন-জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের উন্নত চিকিৎসা দিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের পরিবর্তে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের একাধিক হাসপাতালে পাঠাচ্ছে। চীন, যুক্তরাজ্য থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিম এনে সেবা দিয়েছে।
এদিকে চিকিৎসা, পর্যটনসহ বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশিদের কাছে ভারতের বিকল্প বাজার হয়ে উঠছে থাইল্যান্ড। গত কয়েক মাসে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগী ২০ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে ব্যাংককের ভেজথানি হাসপাতাল, ব্যাংকক হাসপাতাল, কাসেম রাদ হাসপাতাল, সম্মিতিজ সুখুমভিট হাসপাতাল ও এশিয়া কসমেটিক হাসপাতালে রোগী বেড়েছে।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডগামী ফ্লাইটে বেড়েছে যাত্রীর চাপ। থাইল্যান্ডে অবস্থান করা বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন সহজ ভিসা, স্বল্প সময় ও কম বিমান ভাড়া, উন্নত চিকিৎসা, সুলভ মূল্যে থাকা-খাওয়া, আকর্ষণীয় পর্যটন, প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কমসহ নানা সুবিধা বিবেচনায় তারা থাইল্যান্ডে ঝুঁকছেন। ঢাকা থেকে ব্যাংককে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করছে থাই এয়ারওয়েজ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও বাংলাদেশ বিমান। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে থাই এয়ারওয়েজ। চাপ এড়াতে থাইল্যান্ড ১ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশিদের ই-ভিসা দিচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ফ্লাইট চালুর জন্য চিঠি দিয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবায় মালয়েশিয়া প্রথম স্থান অধিকার করেছে। ঢাকার মালয়েশিয়ার হাইকমিশন জানিয়েছে, তাদের চিকিৎসা খরচ থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের চেয়ে অন্তত ৭০ শতংশ কম। তবে ভারতের চেয়ে কিছুটা বেশি। তাছাড়া মালয়েশিয়ায় চিকিৎসকদের জবাবদিহির ব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসা পেতে কেউ ভোগান্তির শিকার হলে, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয় দেশটির সরকার।
মালয়েশিয়া হেলথকেয়ার ট্রাভেল কাউন্সিলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে মালয়েশিয়ায় চিকিৎসা নেন প্রায় সাড়ে ৮ লাখ বিদেশি। সবচেয়ে বেশি সেবা নেন অস্ট্রেলিয়ান; দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশি। থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি মালয়েশিয়াতেও বাংলাদেশি রোগীদের যাতায়াত বেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ভাষাগত জটিলতা কম থাকায় দেশের সাধারণ রোগীদের একটি অংশ ভারত যায়। উচ্চবিত্তদের একটি অংশ যেত থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে। ভারতের দরজা বন্ধ থাকায় নতুন গন্তব্য হিসাবে কেউ কেউ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে বেছে নিচ্ছেন। যারা যেতে পারছে না তারা দেশেই চিকিৎসা নিচ্ছেন, যা দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য একটি সুযোগ। এটাকে কাজে লাগিয়ে রোগীদের ধরে রাখতে হবে। উন্নত দেশের মতো ঝামেলা ছাড়াই রোগ নির্ণয় ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু দেশের হাসপাতালগুলো তা করতে পারছে না। গবেষণা বলছে দেশের চিকিৎসক, নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী ও স্টাফদের রোগীর প্রতি আন্তরিকতা কম, তারা রোগীদের কম সময় দেন। যেটা চাইলেই পরিবর্তন করা সম্ভব। এজন্য হাসপাতাল পলিসিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। রোগীর ওয়েটিং টাইম কমানো, রেশনাল প্রেসক্রিপশন প্রদান, ল্যাবের মান বৃদ্ধি করে উন্নত ডায়াগনসিস করা দরকার। তাতে রোগীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমবে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, ভারতে রোগী যেতে না পারা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য আশীর্বাদ। তবে এটি ঢালাওভাবে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে মনোপলি চিকিৎসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে প্রাইভেট সেক্টরের প্রতিযোগিতায় পাবলিক সেক্টরকে দাঁড়াতে হবে। পাবলিক সেক্টরের সেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। না হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।
মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. লুৎফর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে প্রতিটি হাসপাতালে দুটি জিনিস প্রতিষ্ঠা করা দরকার। প্রথমটি হলো-ইনস্টিটিটিউশনাল প্র্যাকটিস। তিনি বলেন, ‘আমি প্রথম বিএসএমএমইউ ও বারডেমে চালুর সুপারিশ করেছিলাম। পরে সরকার কিছু উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে পাইলটিং করেছিল। এটি পুরোদমে চালু থাকলে সেবাদাতা এবং সেবাগ্রহীতা উভয় শ্রেণি উপকৃত হবে। দ্বিতীয়ত, কোয়ালিটি সার্ভিসের মাধ্যমে হাসপাতালের জরুরি বিভাগকে শক্তিশালী করা। ভর্তি রোগীর বড় একটি অংশ ইমার্জেন্সি বিভাগ থেকে আসে। এক কথায় সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাকন্দ্রেগুলোতে সেবাদানের সঙ্গে জড়িতদের সার্ভিসের কোয়ালিটি, গুণগত চিকিৎসা, যন্ত্রপাতি ও জনবলের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে রোগীদের বিদেশমুখিতা কমবে। যুগান্তর
SN