বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করা নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র লক্ষ্য দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নকে অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তারা।”
রাজধানীর মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের নাম ঘোষণা করা হয়। দলের আহŸায়ক পদে আসা মোঃ নাহিদ ইসলাম একটি লিখিত বক্তব্যে নতুন এই দল গঠনের প্রেক্ষাপট, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো তুলে ধরেন।”
জুলাইয়ে ছাত্র-জনতা বিপুল আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে বলে উলেখ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি। জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী-ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাক্সক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল, যেন জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়।”
এই লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিষ্ঠার কথা উলেখ করেন নাহিদ ইসলাম। তাঁর ঘোষণায়, এই দল হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা করেছে বলে মন্তব্য করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।’
সেকেন্ড রিপাবলিক কেমন হবে, তার রূপরেখাও লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরেছেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা এবং সেগুলোর গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে তাঁদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়া যাবে বলে উলেখ করেন নাহিদ ইসলাম।”
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহŸায়ক নাহিদ বলেন, তাঁরা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চান, যেখানে সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার এবং পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁদের রাজনীতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান হবে না।
সেকেন্ড রিপাবলিকে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে মূলধারায় তুলে আনা হবে বলে জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের রিপাবলিকে সাধারণ মানুষ, একমাত্র সাধারণ মানুষই হবে ক্ষমতার সর্বময় উৎস। তাদের সব ধরনের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষাই হবে আমাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র। আমরা রাষ্ট্রে বিদ্যমান জাতিগত, সামাজিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একটি বহুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই। আমাদের রিপাবলিক সব নাগরিককে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শক্তিশালী সুরক্ষা প্রদান করবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর কোনো অংশকেই অপরায়ণ করা হবে না; বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে সমান গুরুত্ব প্রদান ও সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তুলে ধরেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, তাঁরা কৃষি-সেবা-উৎপাদন খাতের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে এমন একটি জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তুলতে চান, যেটা হবে স্বনির্ভর, আয়-বৈষম্যহীন ও প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল।
নাহিদ ইসলাম বলেন, অর্থনীতিতে সম্পদ একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জীভূত হবে না; বরং সম্পদের সুষম পুনর্বণ্টন হবে তাঁদের অর্থনীতির মূলমন্ত্র। বেসরকারি খাতের সিন্ডিকেট ও গোষ্ঠীস্বার্থ নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ভোক্তা ও জনস্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করবেন বলে উলেখ করেন তিনি। নাহিদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাধ্যমে এই অঞ্চলের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব নিশ্চিত করব এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি খাতে জোর দিয়ে উদ্ভাবনী সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি টেকসই, আধুনিক অর্থনীতি গড়ে তুলবো।”
ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাক্সিক্ষত সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাওয়ার আহŸান জানিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। ‘আমাদের দেশ, আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক অধরা কোনো স্বপ্ন নয়, এটি আমাদের প্রতিজ্ঞা’ বলে বক্তব্য শেষ করেন তিনি।”smk