খ্রিস্টান ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে “স্বপ্নডানা” নামে একটি ভুয়া এনজিও খুলে দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এনজিওর পরিচালক সায়মন বিশ্বাসকে জনগণ আটক করলেও প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। সাইমন বিশ্বাস সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের “পার্সোনাল সচিব” হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে এনজিও কর্মি ও সদস্যদের কাছে আস্থা অর্জন করে।
স্বপ্নডানা এনজিও ২০২৪ সালের জুন মাস থেকে কার্যক্রম শুরু করে। এনজিওটির পরিচালক ধ্রুত সায়মন বিশ্বাস, খুলনা বিভাগীয় প্রধান মেরী বিশ্বাস, যশোরের সাজেদা হক, বরিশাল বিভাগীয় প্রধান রিচার্ড রায় এলিও ও তার স্ত্রী বিউটি সরকার, রাজশাহীর লিয়ন মুরাং ও সুবাসিনি হেমব্রম কে দিয়ে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দরিদ্র সদস্যদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন। তারা আধাপাকা ঘর, চাল, ডাল, চিনি, তেল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
বরিশাল বিভাগীয় প্রধান রিচার্ড রায় এলিও ও তার স্ত্রী বিউটি সরকার জানান, আমাদের দিয়ে ২২৯ সদস্যের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং ১,৫৩২ সদস্যের কাছ থেকে ২,০৪০ টাকা করে উত্তোলন করেন।
মাঠকর্মী রিনা রায় জানান, সংগৃহীত অর্থ বিকাশের মাধ্যমে সায়মন বিশ্বাসের কাছে পাঠানো হয়েছে। নভেম্বরের শেষ দিকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঘর ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করার কথা ছিল।
খুলনা বিভাগীয় প্রধান মেরী বিশ্বাস জানান, আমি না বুঝে খুলনার দায়িত্ব নিয়ে ৩৩৬ জন সদস্যের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করে এনজিওর পরিচালক সায়মন বিশ্বাসকে দিয়েছি। তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন তাই সরল বিশ্বাসে আমি আমার মেয়ের চাকরির জন্য সায়মন বিশ্বাসকে ১ লক্ষ টাকা দিয়েছি। এখন বুঝতে পারছি আমিও প্রতারণার শিকার হয়েছি। সদস্যদের চাপ ও ক্ষোভে দিশেহারা হয়ে আমি এখন বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ দিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছি সুবিচারের আশায়। আমি একটি চাকরি করতাম সে চাকরিটাও হারিয়েছি সদস্যদের চাপের মুখে। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি।
যশোর জেলার কর্মী সাজেদা হক বলেন, আমি ৪০০ সদস্যের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এনজিওর পরিচালক সায়মন বিশ্বাসকে দেই। এছাড়া আমার ছেলের চাকরির জন্য ১লক্ষ টাকা সায়মন বিশ্বাসের সহযোগী নদী মন্ডলকে দিয়েছি।
মেরী বিশ্বাস ও সাজেদা হকের এই বক্তব্য প্রমাণ করে, শুধু সদস্যরা নয়, এনজিওটির ভেতরের কর্মীরাও প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তবে অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের অভাবে ভুক্তভোগীদের কষ্ট দিন দিন বেড়েই চলেছে।
সায়মন বিশ্বাসের সহযোগী নদী মন্ডল বলেন, আমি সায়মন বিশ্বাসকে চিনিনা বলতে বলেছে তাই আমি প্রথমে অস্বিকার করেছি এখন আমি বুঝতে পেরেছি সে একজন প্রতারক। আমার কাছ থেকেও বিভিন্ন সময়ে টাকা নিয়েছে সে।
পরিচালক সায়মন বিশ্বাসের সাথে মুঠো ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পরিচালক সায়মন বিশ্বাস সরেজমিনে না আসায় এবং নভেম্বরের শেষে ঘর বা খাদ্যসামগ্রী বিতরণ না করায় সন্দেহ দানা বাঁধে। পরে একটি সূত্রে সায়মন বিশ্বাসের বাড়ি শনাক্ত করেন মাঠকর্মীরা।
গত ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে মেরী বিশ্বাস এবং বিউটি সরকার সায়মন বিশ্বাসের বাড়ি দেখতে যান। পরে রিংকু রায় নামে একজন ফোন করে জানান যে সায়মন বিশ্বাসকে আটক করা হয়েছে। কোটালীপাড়ার অবদারহাট ঢাকার বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে তারা নিশ্চিত হন যে আটককৃত ব্যক্তি সায়মন বিশ্বাস। অবদারহাট স্থানীয় জনগণ তাকে কোটালীপাড়া পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।
কোটালীপাড়া থানায় সায়মন বিশ্বাসকে আটকে রাখলেও মামলা দায়েরের প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হয়। আগৈলঝাড়া থানার অধীনে ঘটনাটি পড়ায় সেখানকার পিবিআই মামলাটি আগে থেকে তদন্ত করছে বলে মামলা গ্রহণে আপত্তি জানায় আগৈলঝাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ। পরে কোটালীপাড়া থানার পরামর্শ অনুযায়ী, ভুক্তভোগীরা ২০-২২ জন সদস্যকে নিয়ে মামলা দায়ের করতে কোটালীপাড়া থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলে পথিমধ্যে রিংকু রায়, টমাস বাড়ৈ, মেথিও রায়, পিন্টু সমাদ্দার, রনি হাওলাদার, জসিম এবং বুলবুলের নেতৃত্বে একটি চক্র তাদের পথরোধ করে। ভুক্তভোগীদের জোরপূর্বক ফিরিয়ে নিয়ে আসে বিউটি সরকারের বাড়িতে। এ সময় মেরী বিশ্বাস ও বিউটি সরকারকে আটকে রেখে গালাগালি ও শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। সন্ত্রাসীরা বিউটি সরকারের বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে নগদ ৩২ হাজার টাকা, স্বর্ণালঙ্কার সহ আনুমানিক দেড় লাখ টাকার সম্পদ নিয়ে যায়। পরে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করার পর পুলিশ এসে ভুক্তভোগীদের মুক্ত করে। আগৈলঝাড়া থানা পুলিশ মেরী বিশ্বাসকে গাড়ি ভাড়া করে নিরাপদে তুলে দেয়। বিউটি সরকার আরও বলেন, বর্তমানে চক্রটি আগৈলঝাড়া এলাকার স্বপ্নডানার কর্মিদের কাছে টাকা দাবী করে বলে আমরা বিষয়টি দেখবো। টাকা না দিলে প্রতিটি এলাকার সদস্যদের দিয়ে মামলা করানোর হুমকী দিচ্ছে তারা।
আগৈলঝাড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার মতে, “স্বপ্নডানা” এনজিওটি সম্পূর্ণ ভুয়া এবং এর রেজিস্ট্রেশন নম্বরও ভুয়া। সদস্যদের অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য মাঠকর্মীদের ১০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও মূল অপরাধী এখনও বিচারের বাইরে।
সায়মন বিশ্বাসের সাথে ওই চক্রটি জড়িত আছে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা। তা না হলে মামলা দিতে কোটালীপাড়া থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলে পথিমধ্যে তারা বাধা কেন দিলো। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রতারকদের কঠোর শাস্তি এবং আত্মসাতকৃত অর্থ ফেরতের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এনজিওর নামে প্রতারণার এই ঘটনা প্রশাসনের ভূমিকা এবং আইনি প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
TS